গরমে আপনার বাচ্চাকে ভালো রাখবেন কিভাবে
গরমে আপনার বাচ্চাকে ভালো রাখবেন কিভাবে
গরমে শিশুর যত্ন
গ্রীষ্মের তীব্র তাপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বেশ অস্বস্তিকর করে তোলে। আর এই সময়ে আমাদের ছোট সোনামণিদের যত্ন নেওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। বড়দের তুলনায় শিশুরা গরমে খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সহজেই হিট স্ট্রোক বা পানিশূন্যতার মতো সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই গরম থেকে আপনার বাচ্চাকে ভালো রাখা প্রতিটি বাবা-মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়।
এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো গরমে শিশুর যত্নের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে। যাতে আপনার শিশু থাকে সুরক্ষিত ও হাসিখুশি।
কেন গরমে বাচ্চাদের বেশি যত্ন প্রয়োজন:
বাচ্চাদের শরীর তাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বড়দের মতো অতটা দক্ষ নয়। তাদের ঘাম গ্রন্থিগুলোও পুরোপুরি বিকশিত হয় না। ফলে অতিরিক্ত তাপ শরীর থেকে সহজে বের হতে পারে না। এছাড়া, শিশুরা প্রায়শই খেলার ছলে বা অন্য কোনো কারণে নিজেদের শারীরিক অবস্থার দিকে তেমন মনোযোগ দেয় না। তাই তাপমাত্রা একটু বাড়লেই শিশুর গরমের সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। গরমে বাচ্চাদের যত্ন তাই অন্য সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।
গরমে আপনার বাচ্চাকে ভালো রাখবেন কিভাবে: কিছু কার্যকর উপায়
গরমকালে শিশুদের সুস্থ রাখা সহজ নয়। কিন্তু কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে আপনি আপনার সন্তানকে গ্রীষ্মের এই চ্যালেঞ্জিং সময়েও নিরাপদ রাখতে পারবেন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস আলোচনা করা হলো:
১. পর্যাপ্ত পানি পান করান: পানিশূন্যতা রোধই প্রধান লক্ষ্য
গরমে শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পানিশূন্যতা। তাই শিশুর পানিশূন্যতা রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করানো অপরিহার্য। শুধু পানি নয়, ফলের রস (চিনি ছাড়া বা কম চিনি যুক্ত), লেবুর শরবত, ডাবের পানি, বা তরল জাতীয় খাবার, যেমন–পাতলা ডাল, স্যুপ ইত্যাদি শিশুর খাদ্য তালিকায় যোগ করুন। মনে রাখবেন, শিশু খেলার ছলে ভুলে যেতে পারে। তাই নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে পানি বা তরল খাবার অফার করুন। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে শুধু বুকের দুধই যথেষ্ট। গরমে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুদের আলাদা করে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং মা নিজেই যেনো পর্যাপ্ত পানি পান করেন তা নিশ্চিত করুন। শিশুকে পর্যাপ্ত পানি পান করানো গরমে সুস্থ রাখার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
২. সঠিক পোশাক নির্বাচন করুন: হালকা ও আরামদায়ক হোক বাচ্চার পোশাক
গরমে পোশাক কেমন হবে তা গরমে বাচ্চার পোশাক আরামদায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে খুব জরুরী। সিনথেটিক বা ভারী ফেব্রিকের পোশাক পরালে শিশুর গরম লাগা বা ঘামাচি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই সময়ে হালকা রঙের, সুতির বা লিনেন কাপড়ের পোশাক পরানো উচিত। এই ধরনের কাপড় বাতাস চলাচল করতে সাহায্য করে এবং ঘাম শোষণ করে শরীরকে ঠান্ডা রাখে। আঁটসাঁট পোশাকের পরিবর্তে ঢিলেঢালা হালকা সুতির পোশাক বেছে নিন। দিনের বেলায় বাইরে বের হলে টুপি বা ছাতা ব্যবহার করুন।
৩. ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা রাখুন: গরমে শিশুকে ঠান্ডা রাখা সম্ভব
গরমে শিশুকে ঠান্ডা রাখা নিশ্চিত করতে ঘরের ভেতরের পরিবেশ আরামদায়ক রাখাটা খুব জরুরী। দিনের সবচেয়ে গরম সময়ে জানালা ও ভারী পর্দা বন্ধ রাখুন যাতে সরাসরি রোদ ঘরে ঢুকতে না পারে। সন্ধ্যায় বা রাতে যখন বাইরের তাপমাত্রা কমে আসে, তখন জানালা খুলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করলে খেয়াল রাখবেন তাপমাত্রা যেনো খুব বেশি কমানো না হয় এবং সরাসরি ঠান্ডা বাতাস যেনো শিশুর গায়ে না লাগে। আর্দ্রতা বেশি থাকলে ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন।
৪. বাইরের কার্যকলাপ সীমিত করুন: তাপমাত্রা বাড়লে শিশুর যত্ন জরুরী
দিনের বেলায় যখন রোদ সবচেয়ে তীব্র থাকে (সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত), তখন শিশুদের বাইরে খেলাধুলা করতে দেওয়া উচিত নয়। তাপমাত্রা বাড়লে শিশুর যত্ন হিসেবে এই সময়ে তাদের ঘরের ভেতরেই রাখুন। যদি বাইরে যেতেই হয়, তাহলে খুব সকালে বা সন্ধ্যায় যখন আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে তখন যান। পার্ক বা খেলার মাঠে গেলে ছায়াযুক্ত স্থান বেছে নিন। বাইরে বের হওয়া কমানো গরমে শিশুকে নিরাপদ রাখার একটি সহজ উপায়।
৫. খাবার-দাবার: গরমকালে বাচ্চাদের কী খাওয়াবেন?
গরমে শিশুর হজম প্রক্রিয়া অনেক সময় ধীর হয়ে যায়। তাই সহজে হজম হয় এমন খাবার দেওয়া উচিত। ভাজা পোড়া ও অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করুন। খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে পানিযুক্ত ফল যেমন–তরমুজ, বাঙ্গি, শসা, আম, লিচু এবং সহজে হজম হয় এমন সবজি রাখুন। দই, ছানা, পাতলা খিচুড়ি, সাগু ইত্যাদি শিশুর জন্য গরমের খাবার হিসেবে খুব ভালো। অল্প অল্প করে বারবার খাওয়ান। গরমকালে বাচ্চাদের কী খাওয়াবেন এই নিয়ে চিন্তিত হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন।
৬. নিয়মিত গোসল ও পরিচ্ছন্নতা: গরমে শিশুর ত্বক পরিচর্যা
গরমকালে শিশুরা প্রচুর ঘামে। যা থেকে ঘামাচি, র্যাশ বা অন্যান্য ত্বকের সমস্যা হতে পারে। প্রতিদিন স্বাভাবিক ঠান্ডা পানিতে গোসল করানো শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এবং ত্বক পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। গরমে শিশুর গোসল শরীরের তাপমাত্রা কমাতে খুব কার্যকর। দিনের বেলায় সম্ভব হলে শিশুকে বারবার ভেজা নরম কাপড় দিয়ে মুছে দিন। ঢিলা ও পরিষ্কার জামাকাপড় পরান। গরমে শিশুর ত্বক পরিচর্যায় পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই।
৭. শিশুর শরীরের লক্ষণ নজরে রাখুন: অসুস্থতা বুঝবেন কিভাবে?
গরমে শিশুর শারীরিক অবস্থার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। অতিরিক্ত ঘাম, শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ছটফট করা বা অস্বাভাবিক নীরব হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি, মাথাব্যথা, জ্বর, ত্বক লাল হয়ে যাওয়া বা গরম হয়ে যাওয়া। এগুলো গরমে শিশুর অসুস্থতার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্রস্রাব হলুদ হয়ে যাওয়া পানিশূন্যতার স্পষ্ট লক্ষণ। বাচ্চাদের হিটস্ট্রোক লক্ষণ গুলো জানা থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। হিটস্ট্রোকের কিছু গুরুতর লক্ষণ হলো ত্বক অতিরিক্ত গরম ও শুকনো হয়ে যাওয়া এতে ঘাম বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, নাড়ির গতি দ্রুত হওয়া, জ্ঞান হারানো বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
৮. ঘামাচি ও ত্বকের যত্ন: শিশুর ঘামাচি প্রতিকার
গরমের একটি পরিচিত সমস্যা হলো ঘামাচি। ঘাম জমে লোমকূপ বন্ধ হয়ে গেলে ঘামাচি হয়। শিশুর ঘামাচি প্রতিকার হিসেবে শিশুকে ঠান্ডা ও শুকনো রাখার চেষ্টা করুন। সিনথেটিক কাপড়ের পরিবর্তে সুতির পোশাক পরান। ঘামাচিযুক্ত স্থানে ঠান্ডা সেঁক দিতে পারেন। ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ট্যালকম পাউডার ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। কারণ এটি লোমকূপ বন্ধ করে সমস্যা আরও বাড়াতে পারে। ত্বক সবসময় শুকনো রাখুন।
৯. গাড়ি ভ্রমণের সময় সতর্কতা:
গরমের দিনে গাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা দ্রুত অনেক বেড়ে যেতে পারে। তাই শিশুকে নিয়ে গাড়িতে ভ্রমণের সময় অবশ্যই এসি বা ফ্যান ব্যবহার করুন। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোনো অবস্থাতেই শিশুকে একা গাড়ির ভেতর রেখে যাবেন না। এমনকি কয়েক মিনিটের জন্যও নয়। গরমের দিনে গাড়ির ভেতরে থাকাটা শিশুর জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
যদি দেখেন শিশুর মধ্যে নিচের কোনো লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে, তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
★শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া (১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি)।
★অতিরিক্ত ঝিমিয়ে পড়া বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমিয়ে থাকা।
★অতিরিক্ত বিরক্তি বা কান্নাকাটি। যা সহজে থামছে না।
★শুষ্ক মুখ ও ঠোঁট, চোখের পাতা দেবে যাওয়া।
★৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো প্রস্রাব না হওয়া।
★ত্বক অস্বাভাবিকভাবে গরম ও শুকনো হয়ে যাওয়া।
★শ্বাস-প্রশ্বাস বা নাড়ির গতি অস্বাভাবিক হওয়া।
★বমি বা ডায়রিয়া হতে থাকা।
★জ্ঞান হারানো বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (অবিলম্বে ইমার্জেন্সি সার্ভিসকে ফোন করুন)।
এই লক্ষণগুলো হিট স্ট্রোক বা মারাত্মক পানিশূন্যতার ইঙ্গিত। যা শিশুর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
গরমে শিশুদের সুস্থ রাখা বাবা-মায়ের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে এবং সতর্ক থাকলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। পর্যাপ্ত পানি পান করানো, সঠিক পোশাক পরানো, ঠান্ডা পরিবেশে রাখা এবং শিশুর শারীরিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখাই হলো গরম থেকে আপনার বাচ্চাকে ভালো রাখার মূল চাবিকাঠি।
এই আর্টিকেলে দেওয়া গরমে শিশুর যত্ন টিপস গুলো অনুসরণ করে আপনার সোনামণিকে গরমে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখুন। আপনার সামান্য সচেতনতাই গরমে আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। গরমকালে শিশুদের সুস্থ রাখা আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত।
কোন মন্তব্য নেই