এই এগারো রকমের সমস্যা দূর করুন প্রতিদিন মাত্র এই কয়েক মিনিট হেঁটে
নিয়মিত হাঁটার উপকারিতা- নিয়মিত হাঁটলে কি হয়
আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে শরীরচর্চার জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করা অনেকের কাছেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জিমে যাওয়া, লম্বা সময় ধরে দৌড়ানো বা যোগা করার মতো কার্যকলাপ অনেকের জন্যই হয়তো সম্ভব হয় না প্রতিদিন। আমরা প্রায়শই শুনে থাকি সুস্থ থাকতে গেলে দিনে অন্তত ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা হাঁটা জরুরী। কিন্তু যদি আপনার হাতে এতোটাও সময় না থাকে? যদি কাজের চাপে বা অন্য কোনো কারণে আপনি লম্বা সময় শরীরচর্চা করতে না পারেন, তাহলে কি সুস্থ থাকার আশা ছেড়ে দেবেন? মোটেও নয়।
চিকিৎসকদের মতে এবং সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন মাত্র ১৫ মিনিট হাঁটা আপনার স্বাস্থ্যের ওপর অবিশ্বাস্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই স্বল্প সময়ের নিয়মিত হাঁটা অনেক গুরুতর রোগবালাই দূরে রাখতে এবং সামগ্রিক শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে দারুণ কার্যকর। এই আর্টিকেলটিতে আমরা বিশ্লেষণ করবো কিভাবে নিয়মিত হাঁটা বিশেষ করে এই ১৫ মিনিটের হাঁটা, আপনার সুস্থ জীবনযাপনের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে আপনি বুঝতে পারবেন যে নিয়মিত হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী।
আসুন জেনে নিই প্রতিদিন এই অল্প সময় হেঁটে আমরা ঠিক কোন কোন প্রতিদিন হাঁটার উপকারিতা পেতে পারি এবং কিভাবে এটি আমাদের হার্টের স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক শারীরিক সুস্থতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
নিয়মিত হাঁটার উপকারিতা কিঃ
প্রতিদিন ১৫ মিনিটের হাঁটা কি যথেষ্ট? বিজ্ঞান কী বলছে?
অনেকেই ভাবতে পারেন মাত্র ১৫ মিনিট হেঁটে কিভাবে উল্লেখযোগ্য উপকার পাওয়া সম্ভব। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধারণা হলো, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে মাঝারি থেকে তীব্র গতিতে হাঁটলে তবেই তার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা মেলে। এই ধারণা অবশ্যই সত্যি। তবে নতুন গবেষণা আমাদের অন্য একটি দিক দেখাচ্ছে। ব্রিটিশ জার্নাল অফ স্পোর্টস মেডিসিনে প্রকাশিত একটি বৃহৎ গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং দেখিয়েছে যে, স্বল্প সময়ের শারীরিক কার্যকলাপও অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারে। প্রায় ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ওপর করা বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন মাঝারি তীব্রতায় মাত্র ১৫ মিনিট (সপ্তাহে প্রায় ১০৫ মিনিট) হাঁটেন বা অন্য কোনো শারীরিক কার্যকলাপ করেন, তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি যারা একেবারেই শরীরচর্চা করেন না তাদের তুলনায় প্রায় ২৫% পর্যন্ত কম হতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে, নিয়মিত হাঁটা যদি স্বল্প সময়ের জন্যও হয়, সেটি শারীরিক সুস্থতা এবং সুস্থ জীবনযাপন এর জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এই গবেষণা হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরী, তার একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। সুতরাং, সময় কম থাকলেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ১৫ মিনিট হাঁটার সুবিধাও কিন্তু নেহাত কম নয়।
প্রতিদিন ১৫ মিনিট হাঁটার ১১টি অবিশ্বাস্য উপকারিতা:
এবার আসুন জেনে নিই প্রতিদিন মাত্র ১৫ মিনিট নিয়মিত হাঁটা আপনাকে কোন কোন ১৫ মিনিট হাঁটার সুবিধা এনে দিতে পারে এবং প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরী তা আপনি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারবেন। এই প্রতিদিন হাঁটার উপকারিতাগুলো আপনার সুস্থ জীবনযাপনের পথ খুলে দেবে।
যখন আপনি হাঁটেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক সচল হয়। একই পরিবেশে স্থিরভাবে বসে থাকার চেয়ে হাঁটাচলার সময় আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ আরও ভালোভাবে কাজ করে। এটি নতুন ধারণা তৈরি করতে এবং জটিল সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। হাঁটা মনকে শান্ত করে এবং চিন্তা প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তোলে। যা মানসিক স্বাস্থ্য এবং সৃজনশীলতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রতিদিন হাঁটার উপকারিতার মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
২. ক্যালোরি পোড়ানো এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
যদিও দীর্ঘক্ষণ হাঁটা ক্যালোরি পোড়ানোর জন্য বেশি কার্যকর। তবে মাত্র ১৫ মিনিট দ্রুত গতিতে হাঁটলেও আপনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্যালোরি বার্ন করতে পারেন। এটি মেটাবলিজমকে বাড়াতে সাহায্য করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ওজন কমাতে হাঁটা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি স্বল্প সময়ের জন্যও। শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
৩. হৃদপিণ্ড ও রক্তনালীর স্বাস্থ্য উন্নত:
নিয়মিত হাঁটা আপনার হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলে। হাঁটার সময় হৃদপিণ্ডের পেশীগুলো বেশি কার্যকরভাবে পাম্প করে। যা সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। উন্নত রক্ত সঞ্চালনের ফলে অক্সিজেন এবং পুষ্টি শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছায়। বিশেষ করে হৃদপিণ্ডের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী। ১৫ মিনিটের হাঁটাও আপনার হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী, তার একটি বড় প্রমাণ এটি।
৪. মানসিক চাপ ও অবসাদ মুক্তি:
দৈনন্দিন জীবনের কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে হাঁটার জুড়ি নেই। ভোরবেলা বা সন্ধ্যায় প্রকৃতির মাঝে ১৫ মিনিট হেঁটে আসলে মন অনেক হালকা হয়। হাঁটা মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নামক ভালো লাগার হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। যা মানসিক চাপ এবং অবসাদ কমাতে সাহায্য করে। এটি আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রাকৃতিক দাওয়াই। প্রতিদিন হাঁটার উপকারিতার মধ্যে এটি মনকে সতেজ করার জন্য খুব কার্যকর।
৫. অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের স্বাস্থ্য:
বাতের ব্যথা বা জয়েন্টের সমস্যার জন্য হাঁটা একটি চমৎকার ব্যায়াম। নিয়মিত হাঁটা হাঁটু এবং অন্যান্য অস্থিসন্ধির তরুনাস্থিকে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে সাহায্য করে। যা ওই অংশে পুষ্টি সরবরাহ বাড়ায়। এতে জয়েন্টের নমনীয়তা বাড়ে এবং ব্যথা কমে। মাত্র ১৫ মিনিটের হাঁটা আপনার জয়েন্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যা শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরী।
৬. পেটের মেদ কমানো:
শরীরের অন্যান্য অংশের মেদের পাশাপাশি পেটের মেদ কমানো অনেকের জন্যই চ্যালেঞ্জিং। নিয়মিত হাঁটা, বিশেষ করে দ্রুত গতিতে হাঁটা, শরীরের সামগ্রিক মেদ কমাতে সাহায্য করে। যার মধ্যে পেটের মেদও অন্তর্ভুক্ত। কোনো কঠোর ব্যায়াম ছাড়াই ওজন কমাতে হাঁটা একটি কার্যকর উপায়।
৭. মেজাজ উন্নত এবং মনোযোগ বৃদ্ধি:
হাঁটার সময় আপনি আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিতে পারেন বা চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এটি মনকে শান্ত করে এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে ১৫ মিনিটের হাঁটা আপনার মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং দিনটিকে আরও ইতিবাচক করে তোলে। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য মনকে প্রফুল্ল রাখা অত্যন্ত জরুরী।
৮. টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস:
উপরে উল্লিখিত ব্রিটিশ জার্নাল অফ স্পোর্টস মেডিসিনের গবেষণা অনুযায়ী, যারা নিয়মিত দ্রুত গতিতে হাঁটেন (ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার বা তার বেশি), তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। হাঁটা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত হাঁটা অত্যন্ত কার্যকর।
৯. ঘুমের মান উন্নত:
শারীরিক কার্যকলাপ আমাদের শরীরকে প্রাকৃতিক ভাবেই ক্লান্ত করে। যা রাতে ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। নিয়মিত, এমনকি অল্প সময়ের জন্য হাঁটা আপনার শরীরের প্রাকৃতিক ঘুম-জাগরণ চক্র (circadian rhythm) ঠিক রাখতে সাহায্য করে। স্পোর্টস সাইন্স ফর হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের ঘুমের সমস্যা সমাধানে নিয়মিত হাঁটা খুব উপকারী। শারীরিক সুস্থতা ভালো ঘুম নিশ্চিত করে।
১০. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি:
প্রতিদিন মাত্র ১৫ মিনিটের হাঁটা মস্তিষ্কের নতুন কোষ বৃদ্ধিতে (Neurogenesis) উদ্দীপনা যোগাতে পারে। মাঝারি গতিতে হাঁটা মস্তিষ্কের BDNF (Brain-Derived Neurotrophic Factor) নামক একটি প্রোটিন নিঃসরণে সাহায্য করে। যা মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং স্নায়ুতন্ত্র রক্ষায় হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
১১. হজম প্রক্রিয়ার উন্নতি:
খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটা হজমের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি খাদ্যনালীর মাধ্যমে খাদ্যের চলাচলকে ত্বরান্বিত করে। রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া রোধ করে এবং অ্যাসিডিটি বা পেট ফাঁপা কমাতেও সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত হাঁটা সামগ্রিক হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখে। যা সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কিভাবে আপনার প্রতিদিনের রুটিনে ১৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস যোগ করবেন?
১৫ মিনিট হাঁটার সুবিধাগুলো তো জানা গেলো। কিন্তু ব্যস্ততার মাঝে এই ১৫ মিনিট বের করবেন কিভাবে? সেটি একটি প্রশ্ন থেকে যায়। তাই এর কিছু সম্ভাব্য সমাধান নিচে উল্লেখ করা হলো:
✰সকালে: ঘুম থেকে উঠেই দ্রুত ১১ মিনিট হেঁটে আসুন।
✰কাজের ফাঁকে: ফোন কলে কথা বলার সময় হেঁটে নিন বা লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। কাছাকাছি দোকানে যাওয়ার সময় হেঁটে যান।
গুরুত্বপূর্ণ হলো consistency বা ধারাবাহিকতা। প্রতিদিন এইটুকু সময় নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দেখবেন অল্প সময়েই আপনার শারীরিক সক্ষমতা বাড়বে। হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা কার্যকরী, তখন তা আপনি নিজেই অনুভব করবেন।
"সময় নেই" এই অজুহাতকে আজই বিদায় জানান। আজ থেকেই আপনার দিনলিপিতে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস কে অন্তর্ভুক্ত করুন। এই সামান্য পরিবর্তন আপনার শারীরিক সুস্থতা এবং সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
কোন মন্তব্য নেই